বিশেষ প্রতিবেদন: মঙ্গলবার দুপুরেই ভারতীয় রাজনীতিতে অবসান হয়ে গেল প্রণব–যুগের। সেই সঙ্গে পরিসমাপ্তি ঘটে গেল দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে দিল্লির রাজনীতিতে যিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন নিজের পাণ্ডিত্য, বুদ্ধিমত্তা এবং মেধার জোরে, সেই বর্ণময় বাঙালি রাজনীতিবিদের অদম্য বিচরণের। এদিন পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দিল্লিতে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় প্রয়াত নেতার। দিল্লির লোদি রোডে সেনাবাহিনীর গান স্যালুটের মাধ্যমে দেশের ১৩তম রাষ্ট্রপতিকে শেষ বিদায় জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি–সহ দেশের তাবড় রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতিতে এদিন অক্লান্ত এই বঙ্গসন্তান ইতিহাস হয়ে গেলেন!
৯ অগস্ট রাতে দিল্লিতে নিজের বাড়িতে শৌচাগারে পড়ে গিয়ে আঘাত পান তিনি। ১০ অগস্ট সকালে সেনা হাসপাতালে এমআরআই স্ক্যানে তাঁর মাথায় রক্ত জমাট বাঁধার ছবি ধরা পড়ে। জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা। সেই সময়ই করোনা পরীক্ষা করা হলে রিপোর্ট পজিটিভ আসে। তাই মঙ্গলবার দিল্লির রাজাজি রোডের বাড়ি থেকে শুরু করে লোদি রোড মহাশ্মশান পর্যন্ত সব জায়গায় কোভিড প্রোটোকল মেনেই সমস্ত কাজ হয়। তাই সাঁজোয়া গাড়ির পরিবর্তে করোনা বিধি মেনে বিশেষ শববাহী গাড়িতে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। পিপিই পোশাক পরে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করেন ছেলে অভিজিৎ। পরিবারের অন্য সদস্যরাও পিপিই পোশাক পরে শেষকৃত্যে শামিল হন। কোভিড সংক্রান্ত নিয়ম মেনে শ্মশানেও লোকসংখ্যা সীমিত ছিল।
মঙ্গলবার সকালে দিল্লির সেনা হাসপাতাল থেকে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে প্রথমে প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মরদেহ নিয়ে আসা হয় লোদি রোডের ১০ নম্বর রাজাজি মার্গে তাঁর বাসভভনে। গোটা ভারতের নজর ছিল তখন লোদি রোডে। সেনাবাহিনীর তরফে তাঁকে গার্ড অফ অনার দেওয়া হয়। সেখানে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি–সহ শাসক বিরোধী সব দলের রাজনীতিকরা ছুটে আসেন সেখানে। সকলেই তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। তবে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কোভিড সংক্রমিত হয়েছিলেন বলে তাঁর মৃতদেহ বাড়ির একটি ঘরে রাখা হয়। কিন্তু সেখানে কাউকেই যেতে দেওয়া হয়নি। বদলে একটি বেদি তৈরি করে সেখানে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ছবি রাখা হয়। সেই ছবিতেই ফুল মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সকলে।
এদিন সেখানে প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত, সস্ত্রীক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা অধীর চৌধুরী, কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল–সহ বহু নেতা, মন্ত্রী ও সাধারণ মানুষ। তবে পুরোপুরি সেনা নিয়ন্ত্রিত থাকায় কোথাও ভিড় ব্যাপক আকার নিতে পারেনি। রাজাজি মার্গে কিছুক্ষণ মরদেহ শায়িত থাকার পর দুপুর একটা নাগাদ বিশেষ শববাহী গাড়িতে প্রণববাবুর মরদেহ দিল্লির লোধি রোডের মহাশশ্মানে নিয়ে যাওয়া হয়।
শববাহী গাড়িতে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও সকলে পিপিই পোশাক পরেছিলেন। সেখানেও যাবতীয় কোভিড প্রোটোকল মেনে চলা হয়। তার পর পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গ্যান স্যালুটের মাধ্যমে প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায়কে শেষ বিদায় জানানো হয়। তাঁর মৃত্যুতে সোমবারই সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদির সরকার। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রয়েছে। থাকবে সাতদিন। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে পশ্চিমবাংলায় মঙ্গলবার সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এদিকে, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু স্পর্শ করে গিয়েছে বাংলাদেশকেও। তাঁর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ বাংলাদেশ। বুধবার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করবে তারা। বুধবার বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে বলে ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনার পাশাপাশি তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও। তিনি শোকবার্তায় বলেছেন, প্রণব মুখার্জির মৃত্যু ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির জন্য এক ‘অপূরণীয় ক্ষতি’। শোকে স্মৃতিকাতর শেখ হাসিনাও। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও নিজের বহু স্মৃতি এদিন স্মরণ করেন হাসিনা। বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একজন রাজনীতিবিদ ও আমাদের পরম সুহৃদ হিসেবে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অনন্য অবদান কখনও বিস্মৃত হওয়ার নয়। আমি সবসময় মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।’
সোমবারের মতো মঙ্গলবারও প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে বিভিন্ন প্রেক্ষিতের বহু বিশিষ্ট মানুষ গভীর শোক প্রকাশ করেন। ভারতীয় ক্রীড়াজগৎ, শিক্ষাজগৎ এবং সংস্কৃতি জগতের তরফেও বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব ফেসবুকে, টুইটারে এবং সংবাদ মাধ্যমকে নিজেদের শোক জানান। পশ্চিমবাংলার প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত বলেছেন, ‘প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার গোটা স্মৃতিটাই ইতিবাচক। তাঁর সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করা যেত। অনেক সময় একমত না হলেও আলোচনা থামিয়ে দিতেন না। রাজনৈতিক অর্থনীতিটাও তিনি অত্যন্ত ভালো বুঝতেন। সবটাই পর্যালোচনা করতেন গভীর ভাবে। সব ক্ষেত্রেই একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলতেন।’
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেছেন, ‘আমি যে আড়াই বছর ভারতের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছি, সেই সময়ে প্রণববাবুকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। তিনি ছিলেন পোড়খাওয়া একজন রাজনীতিক। যত দিন গিয়েছে, ততই তাঁকে চিনেছি। দেখেছি, ব্যক্তিগত ভাবে মানুষটা ছিলেন খুবই সাদাসিধে। তাঁর মধ্যে একটা বাস্তবানুগ দার্শনিকতা ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র কার্যত মুখস্ত ছিল তাঁর। প্রকৃত অর্থে সেকুলার ছিলেন তিনি।’